ব্ল্যাক বক্স : কি ও কিভাবে কাজ করে

ব্ল্যাক বক্স কি?

৩১ শে জানুয়ারী, ২০০০ এ মেক্সিকো এর পুয়ের্তো ভালার্তা(Puerto Vallarta) থেকে একটা উড়োজাহাজ রওনা হলো ওয়াশিংটন এর সিয়াটল এর উদ্দেশ্যে | মাঝখানে ছোট্ট একটা বিরতি নেবার কথা ছিল সান ফ্রান্সিসকো তে |  যাত্রা শুরুর মোটামুটি ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সেই যাত্রার চির বিরতি ঘটে; বিমানটির stabilizer trim এ গোলযোগ বুঝতে পারেন বিমানের চালক;  তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন বিমানটিকে রক্ষা করার | কিন্তু ১০ মিনিটের মধ্যেই তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে বিমানটি আছড়ে পড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল থেকে দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে | বিমানের মোট ৮৮ জন যাত্রীর কেউই প্রাণে বাঁচেননি |

না চাইলেও এরকম দুর্ঘটনা ঘটে যায় অহরহই | হাজার হাজার ফুট ওপরে হাজার একটা কারণ থাকতে পারে দুর্ঘটনা ঘটার | কি কারণে হলো এরকম ঘটনা; সেটা জানা খুব জরুরি এইজন্যই যাতে সেই ঘটনা গুলো কে বিশ্লেষণ করে পরের দুর্ঘটনা গুলো রোখা যায় | কিন্তু কিভাবে সম্ভব অত ওপরে, ঐরকম সময় কেন এরকম হলো সেটার খোঁজ নেয়া?
ঠিক এই কাজটাই করে ব্ল্যাক বক্স | কিভাবে? সেটাই জেনে নেওয়া যাক |

প্রথমেই জানা যাক মজাদার একটা তথ্য | ব্ল্যাক বক্স এর রং আদৌ কালো নয়; এর রং উজ্জ্বল কমলা | এই ঝকঝকে রঙের ভীষণ মজবুত এবং অসীম সহনশীল পদার্থের তৈরী এই বাক্সটা আসলে দুই ধরনের  ডাটা-রেকর্ডার এর সমন্বয়ে তৈরী একটি single  unit | যাত্রাকালীন সময় এর বিভিন্ন তথ্য - বিমানের কর্মীদের সাথে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এর কথাবার্তা,   - জমা করতে থাকে এটি নিজের ভেতরের রেকর্ডিং সিস্টেম এ |  একটি হলো flight data recorder (FDR), যেটি বিমানের মধ্যের ও সংলগ্ন পরিবেশের বিভিন্ন রকমের শব্দ, চাপ বা তাপের পরিবর্তনের হিসাব এবং আরো অনেক রকমের উড়ান সংস্লিষ্ট তথ্য রেকর্ড করে | আরেকটি হলো cockpit voice recorder (CVR) , যেটি ককপিট এর ভেতরে পাইলটদের নিজেদের মধ্যের কথাবার্তা, পাইলটদের সাথে বিমানের অন্য ক্রুদের কথা, ককপিট এর সাথে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট এর রেডিও কমুনিকেশন রেকর্ড করতে থাকে | অনেক সময় এই FDR আর CVR একসাথে না রেখে সামান্য দুরত্বে বসানো থাকে |
দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর আহত মানুষদের বাঁচানো ছাড়াও উদ্ধারকারী দলের 2nd priority objective থাকে এই বাক্সটাকে খুঁজে বের করে উদ্ধার করা | ব্ল্যাক বক্সের উজ্জ্বল কমলা রং এই সময় সাহায্য করে বাক্সটিকে খুঁজে পেতে | ওই পরিবেশের সাথে খাপছাড়া ওই রং খুব সহজেই চোখে পড়ে |  উদ্ধার করার পর এটি পাঠানো হয় বিশেষজ্ঞের কাছে | তারা ব্ল্যাক বক্সের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসবার চেষ্টা করেন যে দুর্ঘটনার আদতে কারণ টা কি |

এবার জেনে নেওয়া যাক ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ইউ.এস  ডলার মূল্যের এক একটা ব্ল্যাক বক্স কোন গুনের জন্য ওই ভয়াবহ তান্ডবলীলার মধ্যেও টিকে থাকে, কিভাবে তাদের উদ্ধার করা হয়, কিভাবেই বা এদের মধ্যেকার ডেটা এনালাইজ করা হয় |

ভেতরের ব্যাপার

wright ভাইরা শুধু উড়োজাহাজ আবিস্কার করেছিলেন তা নয়, তারাই প্রথম উড়োজাহাজের মধ্যে একধরনের রেকর্ডিং ডিভাইস বসান যেটা প্রপেলার এর রোটেশন রেকর্ড করত | তাই তারা বিমানে কোনো ধরনের রেকর্ডিং ডিভাইস ব্যবহার  করারও পথিকৃত | কিন্তু ব্যাপক ভাবে এই ধরনের রেকর্ডিং ডিভাইস এর ব্যবহার শুরু হয় ২য বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে |
৬০ এর দশক থেকে ব্ল্যাক বক্স এ তথ্য ধরে রাখার জন্য magnatic tape ব্যবহার করা হত, যা এখনো বহুল ভাবে ব্যবহার হয় | কিন্তু airline company গুলো ৯০ এর দশক থেকেই ঝুঁকছিল solid state memory board টেকনোলোজির দিকে | অধুনা, magnatic  tape  ওয়ালা ব্ল্যাক বক্স আর তৈরী হয়না |

ম্যাগনেটিক টেপ ব্ল্যাক বক্স

magnatic tape কাজ করে আমাদের ছোটবেলায় দেখা, এখন বিলুপ্তপ্রায় tape recorder  এর মতই | ছোট ছোট দুটো পুলির মত বসানো থাকে দুপাশে, আর রেকর্ডিং ফিতা এক পুলি থেকে আরেক পুলিতে জড়াতে থাকে একটা electromagnatic  head  এর ওপর দিয়ে | সেই electromagnatic  head  তখন ফিতার ওপর তথ্য গেঁথে দিতে থাকে |

সলিড স্টেট মেমরি বোর্ড ব্ল্যাক বক্স

এবার দেখে নেই যে solid state memory board টেকনোলোজি কিভাবে কাজ করে, যা কিনা magnatic tape  এর থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য | magnatic  tape এর ফিতা বা tape   সব সময়ই নড়তে চড়তে থাকে অর্থাৎ এক পুলি থেকে অন্য পুলিতে সরতে থাকে | যার ফলে, দুর্ঘটনার সময় এটি ছিঁড়ে বা সরে যাবার সম্ভাবনা থাকে | solid state memory board  পদ্ধতি এই ঝামেলা মুক্ত | এতে অনেকগুলো মেমরি চিপ পরপর বিশেষ বিন্যাসে সাজানো থাকে | মেমরি চিপ ব্যবহার করার ফলে এর মধ্যে moving part  কিছু থাকেনা, ফলে কিছু খুলে বা সরে বা ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকেনা |  মেমরি চিপ গুলোর stack টা রাখা থাকে রেকর্ডার এর ভেতরের  crash survival memory unit (CSMU) নামের একটা সিলিন্ডার আকৃতির কম্পার্টমেন্ট এর মধ্যে | FDR এবং CVR এর সংগৃহীত তথ্য এসে জমা হতে থাকে এই মেমরি চিপ গুলোতে |

এই মেমরি বোর্ড CVR  থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ ২ ঘন্টার অডিও ডাটা এবং FDR থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ ২৫ ঘন্টার ফ্লাইট ডাটা ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন |

FDR এর তথ্য যোগানোর জন্য  বিমানের বিভিন্ন জায়গাতে অনেক রকমের সেন্সর লাগানো থাকে | এই সেন্সর গুলো বিমানের ত্বরণ, গতিবেগ, বাইরের তাপ-চাপ, ভেতরের তাপ-চাপ, বিমানের উচ্চতা, ফ্ল্যাপ সেটিং ইত্যাদি বহুরকমের প্যারামিটার মাপতে থাকে এবং পাঠাতে থাকে রেকর্ডার এ  | যেখানে ম্যাগনেটিক টেপ রেকর্ডার মাত্র ১০০ রকমের প্যারামিটার মাপতে পারে, সেখানে সলিড স্টেট রেকর্ডার এইরকম ৭০০ র  ও বেশি পর্যন্ত  প্যারামিটার মাপতে পারে বিমানের আকারের ওপর নির্ভর করে |

সেন্সর গুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো প্রথমে সব চলে যায় flight data acquisition unit (FDAU) এ, যেটি রাখা থাকে বিমানের সামনের দিকে | তারপর FDAU এই তথ্যগুলো পাঠিয়ে দেয় ব্ল্যাক বক্স এ | তাই FDAU  কে বলা হয় মিডল ম্যানেজার |

পাওয়ার সোর্স

ব্ল্যাক বক্স এর পাওয়ার এর যোগান দেয় ২ টা জেনারেটর এর কোনো একটা | একটা জেনারেটর থাকে ২৮ ভোল্টের DC সোর্স এর | আরেকটা থাকে ১১৫ ভোল্টের AC সোর্স এর |

CVR

পাইলট এর হেডসেট
কো-পাইলট এর হেডসেট
থার্ড ক্রু মেম্বার(যদি থাকে)
ককপিট এর ঠিক মাঝামাঝি
এই জায়গাগুলোতে মাইক্রোফোন রাখা থাকে | পাইলটদের নিজেদের মধ্যে কথা, পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন আওয়াজ যেমন কোনো সুইচ টেপার বা কোনো ধাক্কা এইসব গুলো মাইক্রোফোন ধরে নেয় | ধরে নিয়ে পাঠায় associated controll  unit  নামের একটা ইন্টারমিডিয়েট ডিভাইসে | এই ডিভাইসটা ওই শব্দগুলোকে প্রি-এম্পলিফিকেশন করে তারপর পাঠায় CVR এ |

black-box-alaska-cvr

এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, যদি CVR  ৩০ থেকে ২ ঘন্টার শব্দ রেকর্ডের ক্ষমতাসম্পন্ন হয়(টেকনোলজির উপর নির্ভর করে), তাহলে লম্বা উড়ানের সময় এরা কিভাবে এত সময়ের শব্দের হিসাব রাখে | আসলে এরা শেষের দিকের সময় এর হিসাব রাখে | উদাহরণস্বরূপ, ম্যাগনেটিক CVR এর ম্যাগনেটিক টেপ প্রতি ৩০ মিনিটে একটা loop  ঘোরে | অর্থাৎ, টেপ এর একই অংশ ৩০ মিনিট পর পর ঘুরে ঘুরে আসে | আগের ৩০ মিনিটে রেকর্ড করা শব্দ পরের ৩০ মিনিটের শব্দের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যেতে থাকে | তাই এরকম কোনো ব্যাপার নেই যে ঘন্টার পর ঘন্টার উড়ানে হাজার হাজার গজ টেপ লাগে | এই ক্ষেত্রে ঠিক একইভাবে কাজ করে solid state  technology  ও |


bb_transcript

FDR

আধুনিক FDR

FDR এর কাজ হলো বিমানের ভেতর ঘটিত বিভিন্ন action, event, operation এর রেকর্ড রাখা | বিমানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অংশে অনেক রকমের সেন্সর লাগানো থাকে, যারা সংযুক্ত থাকে বিমানের সম্মুখভাগে রাখা flight data acquisition unit (FDAU) এর সাথে |

FDR যেসব ধরনের প্যারামিটার রেকর্ড করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

- time
- pressure altitude
- airspeed
- vertical acceleration
- magnetic heading
- control-column position
- rudder-pedal position
- control-wheel position
- horizontal stabilizer
- fuel flow

ব্ল্যাক বক্স এর টেকনলজির ওপর নির্ভর করে এইরকম ৭০০ ও বেশি প্যারামিটার মাপা যায় | যত বেশি প্যারামিটার মাপা যাবে, বিশেষজ্ঞদের তত বেশি সুবিধা হবে দুর্ঘটনার কারণ সনাক্ত করতে |
USA তে fedarel  aviation administration এর নিয়মানুযায়ী বিমানের আকারের ওপর নির্ভর করে কমপক্ষে ১১ থেকে ২৯ টা প্যারামিটার মাপার ব্যবস্থা থাকতেই হবে | আর যেসব বিমান আগস্ট ১৯, ২০০২ এর পর তৈরী হবে, তাদের কমপক্ষে ৮৮ টা প্যারামিটার মাপার ব্যবস্থা থাকতেই হবে |

CSMU

black-box-cutaway

বেশিরভাগ বিমান দুর্ঘটনায়, ওইরকম ভয়াবহ ধ্বংসলীলার ধাক্কা সামলে টিকে থাকে শেষ পর্যন্ত FDR বা CVR এর অন্তস্থলে রাখা crash survival memory unit (CSMU), যার ভেতরে রক্ষিত থাকে মেমরি চিপ বা ম্যাগনেটিক টেপ | রেকর্ডার এর বাদবাকি অংশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ধংস হয়ে যায় | চোঙ্গাকৃতির CSMU  দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে রেকর্ডার এর চ্যাপ্টা তলের সাথে | কারিগরি উত্কর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন এই CSMU গুলো প্রচন্ড উত্তাপ, তুমুল চুরমার কিংবা টন টন চাপের মধ্যেও টিকে থাকার মত করে তৈরী করা থাকে |
সলিড স্টেট টেকনোলজির ব্ল্যাক বক্স গুলোর CSMU তৈরী হয় ৩ টা layer  | ভেতর থেকে বাইরের দিকে আসতে থাকলে পর পর যে লেয়ার গুলো পাব :
Aluminium Housing - এটি CSMU এর একদম ভেতরের দিকের প্রথম লেয়ার | এটি মেমরি চিপ স্ট্যাক এর চারপাশে ঘেরা এলুমিনিয়াম এর পাতলা পর্দা |
High Temperature Insulation - ১ ইঞ্চি পুরু dry silica এর এই আস্তরণ, বিমান দুর্ঘটনার পরের আগুনের হাত থেকে রক্ষা করে CSMU কে |
Stainless Steel Shell - ভেতরের ওই দুটো আস্তরনকে ঢেকে রাখে বাইরের এই stainless steel এর খোলক | এর পুরুত্ব ০.২৫ ইঞ্চি হয় | অনেক সময় স্টীল এর বদলে titanium ও ব্যবহার করা হয় |

CSMU এর পরীক্ষা

এবার দেখা যাক, CSMU কে পরীক্ষাগারে কি কি ভাবে পরখ করা হয় এর সহনশীলতা পরীক্ষা করার জন্য | দুর্ঘটনার পর আর যাই নষ্ট হোক না কেন, CSMU  র টিঁকে থাকা সবচে জরুরি; তাই এটাকে ভয়াবহ রকমের পরীক্ষায় পাস করতে হয় | প্রথমে ইঞ্জিনিয়াররা CSMU  র ভেতরের মেমরি চিপগুলোতে কিছু ডেমো তথ্য ঢোকান | এরপর সমস্ত রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হবার পর তারা আবার টেস্ট করে দেখেন যে তথ্য গুলো অবিকৃত আছে কিনা, আগের মতই হুবহু আছে কিনা | এবার যাওয়া যাক পরীক্ষাগারে:

Crash Impact - এই পরীক্ষাতে বিশেষজ্ঞরা CSMU টা কে air - cannon (এয়ার-গান এর বড় সংস্করণ আর কি)  এ ভরে একটা এলুমিনিয়াম এর তৈরী টার্গেট এর দিকে নিক্ষেপ করেন ৩৪০০ G  এর সমান ধাক্কা তৈরী করার মত গতিবেগ নিয়ে |  এখানে বোধহয়  G  সম্পর্কে একটু বলা দরকার | ১ G হলো পৃথিবীর অভিকর্ষ যে বল তৈরী করে তার পরিমাপ | G  যত বাড়বে কোনো বস্তুর ওজন তত বেশি হবে | উদাহরণ দেয়া যাক | একটা ফাইটার প্লেন তীব্র গতিতে চলার সময় যখন আচমকা মোড় ঘোরে তখন বৈমানিক ৫ G  পর্যন্ত বল অনুভব করে তার শরীরে | এটা তৈরী হয় মোড় ঘোরার সময় উত্পন্ন অপকেন্দ্র বলের জন্য | সেই বৈমানিক এর স্বাভাবিক ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, সেই মুহুর্তে তার ওজন হবে ৬০ x ৫ = ৩০০ কেজি !!! সেই মানুষটিরই চাঁদে গেলে ওজন হবে ৬০/৬ = ১০ কেজি | কারণ, চাঁদের অভিকর্ষ বল ১/৬ G  | যাই হোক, ফিরে আসি CSMU তে | ৩৪০০ G নিয়ে যখন CSMU ধাক্কা খায় এলুমিনিয়াম এর টার্গেট এ, তখন প্রকৃতপক্ষে CSMU এর যা ওজন তার থেকে ৩৪০০ গুন ওজনে ধাক্কা খাওয়ার এফেক্ট হয় | সত্যিকারের দুর্ঘটনা ঘটলে CSMU যতটা বলের সম্মুখীন হবে, পরীক্ষাগারে সৃষ্ট বল তার থেকে বেশি বা তার সমান সমান থাকে |
Pin Drop - CSMU কে কোনো তীক্ষ্ণ জিনিস ভেদ করতে চাইলে সেটা কতটা সহ্য করতে পারে সেটার টেস্ট করার জন্য ১০ ফুট ওপর থেকে ২২৭ কেজি একটা ওজন ফেলা হয় | এই ওজনের সামনে একটা ০.২৫ ইঞ্চি ব্যাস এর একটা পিন লাগানো থাকে | এমনভাবে ফেলা হয় ওজনটা যাতে ওটা আঘাত করে CSMU এর সবচে দুর্বল পয়েন্ট এ |
Static Crush - এই পরীক্ষাতে CSMU এর প্রধান ৬ টা পয়েন্টে ৫০০০ পাউন্ড/বর্গইঞ্চি বল প্রয়োগ করা হয় ৫ মিনিট যাবত |
Fire Test - CSMU টাকে ৩ টা বার্নার দিয়ে প্রোপেন-ইন্ধন আগুনে উত্তপ্ত করা হয় ১ ঘন্টা ধরে | ওই আগুনের উত্তাপ থাকে তখন ১১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস | তুলনা করার জন্য বলা যায়, সিগারেটে টান দেয়ার সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌছায় মোটামুটি ৭০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে |
Deep Sea Submersion - গভীর সমুদ্রে টিঁকে থাকে কিনা সেটা নিশ্চিত করার জন্য CSMU  টাকে উচ্চচাপে একটা লবন পানির ট্যান্ক এ রাখা হয় ২৪ ঘন্টা |
Salt Water Submersion - লবনাক্ত পানিতে সহনশীলতা দেখার জন্য CSMU কে রাখা হয় লবন পানির ট্যান্ক এ ৩০ দিনের জন্য |
Fluid Immersion - দুর্ঘটনার সময় CSMU সম্ভাব্য যেসব তরল পদার্থের সংস্পর্শে আসতে পারে, সেই সব ধরনের তরলে ডোবানো হয় CSMU কে | যেমন, ফুয়েল, লুব্রীকেন্ট্স বা অগ্নি নির্বাপক রাসায়নিক ইত্যাদি |

এইসব চূড়ান্ত পরীক্ষা পার হয়ে তবে CSMU পায় যোগ্যতার ছাড়পত্র | ব্ল্যাক বক্স বসানো থাকে বিমানের লেজ এর দিকে | কারণ, এটা প্রমানিত যে দুর্ঘটনার ধাক্কা সবচে কম পড়ে বিমানের লেজ এর দিকের অংশে | তাই ওখানে থাকলে ব্ল্যাক বক্স বেঁচে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ |

ব্ল্যাক বক্স এর নাম "ব্ল্যাক" বক্স কেন

ব্ল্যাক বক্স এর রং উজ্জল কমলা হওয়া সত্বেও একে "ব্ল্যাক" বক্স কেন বলে সেটা নিয়ে কয়েকটা মত আছে | আগে  এই রেকর্ডারগুলোর রং হত কালো; তাই অনেকে বলেন যে এর থেকেই এই নামের উত্পত্তি | আবার কেউ কেউ বলেন, দুর্ঘটনার পর আগুনে পুড়ে এর রং কালো হয়ে যায় বলেই এরকম নামে একে ডাকা হয় | অনেকে আবার বলেন, দুর্ঘটনা, মৃত্যু এসব খারাপ ব্যাপারকে মাথায় রেখেই এরকম নাম দেয়া হয়েছে | নামের কারণ যাই হোকনা কেন, এর কাজ সেই একই | শেষ মুহূর্ত গুলোকে ধরে রাখা | আর এই শেষ মুহুর্তগুলোর তথ্য উদ্ধারের জন্য একে খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি |

দুর্ঘটনার পর

ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য একে টকটকে কমলা রঙ্গে রঞ্জিত করার পাশাপাশি আরো কিছু কারিগরী ফলানো হয় | যানবাহনের গায়ে বা হাইওয়ের পাশে রোডসাইন গুলোতে যেমন refelctive material লাগানো থাকে, তেমনি টেপ লাগানো থাকে ব্ল্যাক বক্স এর গায়ে | সবচেযে গুরুত্বপূর্ণ  যে জিনিস লাগানো থাকে সেটা হলো underwater locator beacon |

পাশের ছবিটা হলো underwater locator beacon  এর ক্লোজ-আপ ফটো | L3  communications  লেখা সাদা রঙের সিলিন্ডার আকৃতির জিনিসটাই হলো underwater locator beacon | এটি আবার ব্ল্যাক বক্স বয়ে নিয়ে যাবার সুবিধার জন্য হাতল হিসাবেও কাজ করে | ছবিতে underwater locator beacon এর বাম দিকে সাদার মধ্যে কালো ফোঁটা ওয়ালা চোখের মত যে অংশটা দেখা যাচ্ছে, সেটি হলো submergence sensor নামের এক বিশেষ ধরনের সেন্সর | পানির সংস্পর্শে এলেই এই সেন্সরটা underwater locator beacon টাকে চালু করে দেয় | যে এটা চালু হয়, তারপর থেকে underwater locator beacon টা প্রতি সেকেন্ডে একবার করে ultrasonic শব্দের ঢেউ ছাড়তে শুরু করে আগামী ৩০ দিন পর্যন্ত | এমনকি ১৪০০০ ফুট পানির নিচে থেকেও এটি কাজ করতে সক্ষম | এর থেকে নির্গত শব্দ মানুষের কানে ধরা পরেনা ঠিকই, কিন্তু sonar  বা acoustical   locating যন্ত্রের দ্বারা এই শব্দ সনাক্ত করা যায় |
ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়ার পর চেষ্টা করা হয় আর কোনমতেই যেন এর রেকর্ডিং ডিভাইসগুলোর আর কোনো ক্ষতি না হয় | যেমন ভাবে পাওয়া যায়, চেষ্টা করা হয় যেন সেইভাবেই এটাকে পরীক্ষাগারে নিয়ে যাওয়া যায় | সেই কারণে, ব্ল্যাক বক্স পানি থেকে উদ্ধার করা হলে একে পানিভর্তি কন্টেইনারে চুবিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে একে যে পরিবেশে পাওয়া গেছে তা অক্ষুন্ন থাকে | পরীক্ষাগারে গেলে পড়ে বিশেষজ্ঞরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করেন |

তথ্য পুনরুদ্ধার

ল্যাব এর নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় FDR আর CVR , দুটো থেকেই তথ্য উদ্ধারের সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া | আধুনিকতম প্রযুক্তির যন্ত্র, সফটয়্যার ব্যবহার করেও কখনো কখনো সপ্তাহ, এমনকি মাস ও লেগে যায় এর তথ্য উদ্ধারে |

FDR যদি ঠিকঠাক থাকে তো এর মেমরি বোর্ড থেকে তথ্য উদ্ধার সামান্য সময়ের ব্যাপার | কিন্তু খুব সঙ্গত কারণেই, বেশিরভাগ সময়েই একে পাওয়া যায় ভাঙ্গাচোরা অবস্থাতে | তখন একে খুলে ফেলে ভেতর থেকে মেমরি বোর্ডগুলো বের করে ফেলে নতুন মেমরি ইন্টারফেস কেবল লাগিয়ে একে সংযুক্ত করা হয় এমন আরেকটা FDR  এর সাথে যেটা কর্মক্ষম আছে | এই নতুন FDR  এর ভেতর এমন সফটয়্যার থাকে যেটা তথ্য উদ্ধারের পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখে কি আগের তথ্য যেন ওভাররাইট না হয়ে যাক |
সবচে ঝামেলার কাজ হলো CVR এর তথ্য উদ্ধার করা | এই কাজের জন্য রীতিমত একটা বিশেষজ্ঞ দল তৈরী করা হয় | এই দল এ থাকে এয়ারলাইন থেকে একজন প্রতিনিধি, বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থার লোক, পরিবহন-নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ, উড়ান-নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইনভেস্টিগেটর | এছাড়াও থাকতে পারে ভাষা-বিশেষজ্ঞ এবং খুব প্রয়োজন হলে দোভাষীও | এরা মিলেই সম্পন্ন করেন ব্ল্যাক বক্স থেকে তথ্য উদ্ধারের অসীম ধৈর্যের এই সময়সাপেক্ষ কাজটি |


বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অমুল্য প্রয়োজনীয় এই  যন্ত্রটি দিনে দিনে আরো উন্নত হয়ে উঠছে এবং উড়ান নিরাপত্তাকে করে তুলছে আরো নিখুঁত |

তথ্যসুত্র : http://electronics.howstuffworks.com/gadgets/other-gadgets/black-box.htm
http://en.wikipedia.org/wiki/Flight_data_recorder

দুর্ঘটনার পর ইজিপ্ট এয়ার এর ফ্লাইট ৯৯০ এর তুবড়ে যাওয়া FDR

Level 0

আমি অনুপ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 144 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

    আপনাকেও ধন্যবাদ আমার প্রথম টিউন এর প্রথম কমেন্টার হবার জন্য

    আমারও ভালো লাগে জানতে ও শিখতে | তাই এই তথ্য আদান প্রদানের চেষ্টা | ভালো থাকবেন |

অসাধারন।আশা করছি আপনার মাধ্যমে এমন তথ্যবহুল টিউন আমরা পাবো।টিউনটি করতে যে সময়,শ্রম ব্যয় করেছেন এবং ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য সাধুবাদ জানাচ্ছি।

    আপনার সুন্দর কমেন্ট পড়ে উত্সাহ পাচ্ছি আরো লেখার জন্য | আপনি যেভাবে উদ্বুদ্ধ করলেন সেটাও একটা অসাধারণ ব্যাপার | খুশি থাকুন জীবনে প্রবাসী ভাই |

চমৎকার হয়েছে। পরবর্তিতে আরও এরকম ভাল ভাল টিউন আপনার কাছ থেকে আশা করি।

    আশা করি আপনাকে আশাহত করবনা | ভালো থাকবেন |

এক কথায় ক্লাস টিউন,
এই রকম তথ্য বহুল টিউন টেকটিউন্সে অনেক কম হয়,
আশা করছি সামনেও এই রকম অসাধারন টিউন উপহার দিবেন আমাদের,
আমি মনে করি টিউনটি ষ্টিকি হওয়ার দাবি রাখে,কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকষর্ন করছি,
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর টিউনটি আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।

    আপনার প্রানখোলা ও আন্তরিক উত্সাহের জন্য আমি ভীষণ আপ্লুত | knowledge sharing এর জন্য আরো আগ্রহ বাড়িয়ে দিল আপনার দেয়া উদ্দীপনা |

Level 0

বিনা হিশাবে এ+ দিয়ে দিলাম।লেখকের অনুমতি পেলে এই লেখাটি আমার ব্লগ এ প্রকাশ করতে চাই

    নির্দ্বিধায় আপনার ব্লগ এ প্রকাশ করতে পারেন | জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ুক; এটাই কাম্য | আপনার সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন রইলো | আপনার ব্লগে লেখা প্রকাশের সময় আমার লেখাটির link দিয়ে দিলে আরো ভালো লাগবে |

আল কোরান এ সব বলা আছইন.!

    প্রথমে আপনার কমেন্ট পড়ে চমকে গেলাম | পরে বুঝলাম আপনি রাগ করে এরকম বলেছেন | কারণ, এর আগে অন্য আরো কয়েকটা টিউনে আপনার নাম নজরে পড়েছে, যেখানে আপনি আপনার কমেন্ট এর জন্য তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন | যেমন :

    https://www.techtunes.io/reports/tune-id/17963/
    https://www.techtunes.io/news/tune-id/26422/
    https://www.techtunes.io/internet/tune-id/24931/
    https://www.techtunes.io/internet/tune-id/24853/

    ঐসব টিউনে আপনার কমেন্ট পড়ে আমার মনে হয়েছে ধর্ম সম্পর্কে আপনার বিরোধিতা নেই কিন্তু আপনার কাছে বিজ্ঞানের প্রায়োরিটি বেশি | অনেকেই আপনাকে ভুল বুঝেছে |
    যাই হোক, আমার মনে হয়, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার যেকোনো চেতনাযুক্ত প্রাণীরই আছে | তাই,আমি আপনাকে অনুরোধ করব যে আপনি আমার এখানে আবার আপনার কমেন্ট দিন | এবং এবার আপনার মনের কথাটাই বলুন |
    ভালো থাকবেন ভাই |

Level 0

gd job..

খুব অসাধারন একটা টিউন করেছেন। এমন টিউন সব সময় পাওয়া যায় না।
অসীম ধন্যবাদ ভাই।

    ভালো লাগলো আমার ভালো লাগাটা আপনার মধ্যেও ছড়াতে পেরে |

হুম্ম !! প্রথম টিউন নাকি? ভালই তো হয়েছে, তবে অনেক খাটাখাটনি করেছেন বোঝা যাচ্ছে। এত্ত তথ্য দিয়ে টিউনটা করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলাম আর বরণ করে নিলাম টেকটিউনসে।

আপনার টিউন টি পড়ে খুব ভাল লাগল। নতুন কিছু জানতে পারলাম।
আশা করি এভাবে নতুন নতুন সব জটিল বিষয় জানিয়ে যাবেন।
————————————————————————————-
অটঃ আপনি কি লিনাক্স ফোরামের অনুপ।

    ধন্যবাদ ভাই হাসিবুল হাসান |
    ভালো লাগা জিনিসগুলো আপনাদের সাথেও শেয়ার করব সব সময় আশা করি

    আমি linux forum এর অনুপ নই |

কয় দিন লাগছে লিখতে??? আল্লাহামদুলিল্লাহ জট্টীল মামা জট্টিল………

লিখতে যে কয়দিনই লাগুক, আপনাদের এইরকম সাড়া পেলে কলম (থুক্কু !! আঙ্গুল) চালিয়ে যাব ইনশাল্লাহ !!!!

Besh valo laglo…